মাথা নিচু করে বসে আছে আমজাদ। ওসি রুদ্র তালুকদারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে না। তার মাথা নিচু করার ধরনটাও যে ঠিক অপরাধীর মতো, তা নয়। বরং ভাবলেশহীন একটা চেহারা তৈরি হয়ে আছে তার; যেন থানায় নয়, রেলের টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়িয়েছে। ফুলহাতা শার্টের আস্তিন তার কবজি অবধি ঢেকে রেখেছে। দামি ঘড়িটা কাপড়ের প্রান্ত দিয়ে উঁকি দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। একবার–দুবার সময় দেখেছে সে তাতে। কিন্তু কোনো তাড়া প্রকাশ পায়নি আচরণে। রাজ্যের সময় যেন হাতে।
: সরাসরি পয়েন্টে চলে আসা যাক।
বলল রুদ্র। শুনে মাথাটা ওপরে তুলে নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল ছেলেটা। রুদ্র টের পেল, আমজাদের চেহারায় চাপা একটা বিষাদ রয়েছে। একজন পেশাদার খুনির সাথে কোনোভাবে যায় না চেহারাটা।
: জি, বলুন।
নম্র কণ্ঠ, মার্জিত উচ্চারণ। মুগ্ধ হলো রুদ্র। কত বয়স হবে এর? ২৮ বা ২৯? আরও কম হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করে, গান গায়—এমন একটা কণ্ঠ।
: আপনি বুয়েটে পড়াশোনা করেছিলেন না? এরপরও এমন একটা পেশা কীভাবে বেছে নিলেন?
: ড্রপআউট ছিলাম, সেকেন্ড ইয়ারের পর আর কন্টিনিউ করিনি।
: সরাসরি কন্ট্র্যাক্ট কিলার হয়ে গেলেন?
প্রচ্ছন্ন লজ্জা, প্রকট বিব্রতবোধ দেখা গেল তার চোখেমুখে।
: আমি যে কন্ট্রাক্ট কিলার এমন কোনো প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে?
: গত দুই বছরে সাতটা খুন হয়েছে ঢাকা শহরে, ভিকটিম সবাই ছিল বিগশট—দুজন পলিটিশিয়ান, একজন অভিনেত্রী, তিনজন ব্যবসায়ী আর একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। এদের সবার মধ্যে একটা কমন বিষয় ছিল, মৃত্যুর কিছুদিন আগে আপনার সাথে বন্ধুত্ব হয় সবার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, পাবলিক প্লেসে আপনার সাথে এদের ছবি রয়েছে।
হাসল আমজাদ। এবার তার হাসিতে ব্যঙ্গ।
: প্রথমত, এদের কেউ খুন হয়নি। সবাই মারা গিয়েছে স্বাভাবিকভাবে বা অ্যাক্সিডেন্টে। হার্ট অ্যাটাক, রোড অ্যাক্সিডেন্ট, স্ট্রোক এমনকি একজনের ক্যানসারও হয়েছিল। এরা খুন হয়েছে—সে তথ্য সঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, যদি খুন হয়েও থাকে, তাতে আমার ভূমিকা কোথায়? কারও সাথে পরিচিত হলেই তো আর খুন করা হলো না তাকে!
: আপনি বলতে চাইছেন, এতগুলো মানুষ মারা যাবার আগে আগে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করেছে, ব্যাপারটা স্রেফ কাকতালীয়?
: আর কী হতে পারে?
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
: হ্যাঁ, আমিও ঠিক এই কথাটা ভেবেছিলাম, স্রেফ পরিচিতি, বন্ধুত্ব ছিল বলে তো আর সন্দেহ বা গ্রেপ্তার করা চলে না কাউকে! কিন্তু গত এক সপ্তাহে আমরা দুটো কনফেশন পেয়েছি। যারা আপনাকে খুনগুলো করার জন্য ভাড়া করেছেন, তাদের। তাদের ভাষ্যমতে, আপনি এমনভাবে খুনগুলো করেন, যে দেখে অ্যাক্সিডেন্ট বা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয়। অস্বীকার করবেন, আপনি খুনগুলো করার জন্য পয়সা নেননি?
: উঁহু, করব না। নিয়েছি আমি টাকা। কিন্তু খুন করেছি, সেটা সত্য নয়।
: তাহলে টাকা নিয়েছেন কেন?
ঠোঁট ওলটাল আমজাদ।
: খরচ চালানোর জন্য।
বিরক্ত হলো রুদ্র। খুনগুলো সে কী উপায়ে করেছে, তা না জানলে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হবে।
: ঠিক আছে, অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা যাক। বুয়েটে ড্রপআউট হলেন কীভাবে?
: আমার প্রেমিকা মারা যায়, হতাশায় ভুগছিলাম।
: কীভাবে মারা যায়?
: ডিসফ্যাগিয়া, একদিন রাতে গলায় খাবার আটকে গিয়ে মারা যায়।
: এমনটাও ঘটে, জানা ছিল না!
: খুবই কম, হয়তো লাখে একজনের ক্ষেত্রে ঘটে।
: এই শোকে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন?
: সত্যি বলতে, ব্যাপারটা শুরু হয় আরও আগে থেকে।
: আরও আগে থেকে?
: আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা যায়। ব্যাপারটা শুরু হয় তখনই।
: কী শুরু হয়?
: শুরু হয় আমাকে ঘিরে থাকা অভিশাপ। ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়, যখন আমার ফুফুর মৃত্যু ঘটে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। এরপর ফুফুই আমাকে লালন–পালন করেন। যখনই আমার মনে ফুফুর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হলো, এর কিছুদিন পরই তিনি মারা গেলেন। এরপর একটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। আতিফ নামের একটা ছেলের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হলো আমার এবং মাসখানেকের মধ্যে পানিতে ডুবে মারা গেল সে। বুঝলাম, এক অদ্ভুত অভিশাপ রয়েছে আমার ওপর: যার সাথেই সখ্য তৈরি হয়, ঘনিষ্ঠতা হয়, সে–ই মারা যায়। কীভাবে যে ব্যাপারটা ঘটে জানি না, কিন্তু ঘটে। ব্যাপারটা নিশ্চিত হলাম আমার প্রেমিকা টিনার মৃত্যুর পর। ওর মৃত্যুর পর খুব লোনলি হয়ে গেলাম, ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম, কন্ট্রাক্ট কিলার হব আমি। যে কাউকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হলে আমাকে শুধু একটাই কাজ কর তে হবে—তার সাথে বন্ধুত্ব!
হো হো করে হেসে উঠল রুদ্র।
: এ গল্প আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?
: উঁহু, মোটেই না। কারণ গল্পটা যেমন সত্য, তেমনি অবিশ্বাস্য ও অপ্রমাণযোগ্য। আপনার কি একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না?
একমুহূর্ত ভাবল রুদ্র।
: না, হচ্ছে না।
: একটা উপায় কিন্তু আছে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের। আমার সাথে বন্ধুত্ব করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। করবেন? বন্ধু হবেন আমার?
হাত বাড়িয়ে দিল আমজাদ।
একরাশ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে সেদিকে চেয়ে রইল রুদ্র। দুলতে লাগল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। লোকটার হাতটা ধরা কি উচিত হবে?